লুঝনিকির সন্ধ্যায় কার মাথায় মুকুট

কদিনের উজ্জ্বল রোদের পর মস্কোর আকাশে আবার ফিরে এসেছে মেঘ। কাল দুপুর থেকেই মেঘের ওড়াউড়ি। রোদ-ছায়ার লুকোচুরিতে কত রং ভাসছে। কখনো নীল, কখনো ধূসর, কখনো বৃষ্টির বার্তা নিয়ে সজল কালো মেঘ। তবে আজ আকাশ যদি বৃষ্টিও ঝরায় লুঝনিকিতে, রঙের বাহার থামবে না। সন্ধ্যায় ফ্রান্সের নীল-লাল-সাদা হবে লুঝনিকি স্টেডিয়ামের ছোট্ট আকাশ, কিংবা ক্রোয়েশিয়ার লাল-সাদায় হবে মাখামাখি।

আজ বিশ্বকাপের ফাইনাল। এই ফাইনালই হয় ফ্রান্সকে দেবে বিশ্বসেরার দ্বিতীয় মুকুট নতুবা ক্রোয়েশিয়াকে শ্রেষ্ঠত্বের অভিষেক। আর প্রকৃতপক্ষে লুঝনিকির ছোট্ট আকাশ ছাপিয়ে ফুটবল পৃথিবীর আকাশটাই রাঙা হয়ে উঠবে একটি রঙে। তেরঙা জাতীয় পতাকা হলেও ফ্রান্সের রং আসলে নীল। দুই রঙের জাতীয় পতাকা নিয়েও ক্রোয়েশিয়ার পরিচয় লালে। তাহলে আজ সন্ধ্যায় ফুটবল পৃথিবীর রং হবে নীল কিংবা লাল। লাল অথবা নীল। আর এটাই পৃথিবীজুড়ে জেগে থাকবে আগামী চারটি বছর।

আগামী চার বছরের ফুটবল পৃথিবীর অধিকার নিতে আজ লড়াই হবে তারুণ্যদীপ্ত ফ্রান্সের সঙ্গে প্রতিজ্ঞাদীপ্ত ক্রোয়েশিয়ার। তারুণ্যের ফ্রান্স আবার অভিজ্ঞতায়ও ঋদ্ধ, মানে এই সোনার কাপটি একবার ছুঁয়ে দেখার অভিজ্ঞতা তাদের আছে। প্রতিজ্ঞাদীপ্ত ক্রোয়েশিয়া আবার অনভিজ্ঞও, মানে কাপটা ছুঁয়ে কখনো দেখা হয়নি যাদের। ২০ বছর আগে বেশ কাছে গিয়ে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল, শেষ চারে সেই স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছিল এই ফ্রান্স। স্বপ্নঘাতক ফ্রান্সের সেই দলটির অধিনায়ক আজ ডাগআউটে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।

ক্রোয়েশিয়ার কোচ জ্লাতকো দালিচ সেদিন তুলেছেন এই প্রসঙ্গটিই। ফ্রান্স কত অভিজ্ঞ, ফ্রান্সের কোচের সঙ্গে তাঁর কোনো তুলনা হয় না। দিদিয়ের দেশম একবার সোনালি ট্রফিতে হাত ছুঁইয়েছেন, আর তিনি স্বপ্ন দেখছেন ট্রফিতে হাত ছোঁয়ানোর।

২০ বছর আগে ক্রোয়েশীয় স্বপ্নের ধ্বংসাবশেষ থেকেই বিশ্বসেরার মুকুট পরেছিল ফ্রান্স। বারবার ফরাসি দলটির কাছে ছুটে যাচ্ছে সেই ১৯৯৮ বিশ্বকাপ। কোচ দিদিয়ের দেশম সেটি সযতনে এড়িয়ে যেতে চাইছেন। চাইছেন না সেই সাফল্যের স্মৃতি তাঁর তরুণ দলটির ওপর চাপ হয়ে আসুক। কিন্তু চাইলেই তো এড়িয়ে যাওয়া যায় না। প্রশ্নটি আসছে এবং দেশম টেনে আনছেন দুই বছর আগের একটি ফাইনালের ব্যর্থতা। দেশের মাটিতে ২০১৬ ইউরোর ফাইনালে পর্তুগালের কাছে হারের ক্ষত। বলছেন, সেই হার থেকে শিক্ষা নিয়েই মানসিকভাবে তৈরি হয়েছে এই দলটি। কাল লুঝনিকি স্টেডিয়ামের সংবাদ সম্মেলনে কোচের সুরেই সুর মেলালেন অধিনায়ক হুগো লরিস। টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা গোলকিপারের চোখে ক্রোয়েশিয়া দলটি অসাধারণ, ‘ক্রোয়েশিয়া দুর্দান্ত লড়াকু দল। টানা তিনটি ম্যাচ ১২০ মিনিটের লড়াইয়ে জিতে দেখিয়েছে তাদের অদম্য মানসিকতা। আমরা ওদের শ্রদ্ধা করি। ওদের সঙ্গে লড়তে গেলে শারীরিক-মানসিক দুইভাবেই শক্ত হতে হবে আপনাকে। আমরা সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছি।’

লরিসের মুখে বারবার মানসিক শক্তির কথা। দেশমের মুখেও মানসিকতার কথা। শোনা গেল, সেন্ট পিটার্সবার্গে বেলজিয়ামকে সেমিফাইনালে বিদায় দেওয়ার পর এই মানসিক শক্তির দিকটাতেই বেশি জোর দিয়েছে লে ব্লু। কারণ, ফ্রান্স জানে, তাদের দক্ষতা আছে, কিন্তু একেবারেই তরুণ দলটির দরকার শুধু মানসিক দৃঢ়তা।

তবে আগের দিন ইস্ত্রার সংবাদ সম্মেলনে আঁতোয়ান গ্রিজমান বা ব্লেইস মাতুইদির কথা শুনে মনে হয়েছে, টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ দলটির মস্তিষ্ক অনেক পরিণত। তাঁরা তারুণ্যের উচ্ছ্বাসের সঙ্গে পরিণতিবোধেরও পরিচয় রাখতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

ফ্রান্স দলের জার্সিতে বুকের কাছে মুরগির ছবি, তার ওপরে একটি তারা। এবার বিশ্বকাপ জিতলে ওখানে আরেকটি তারা যোগ হবে। গ্রিজমান তাঁর গোল বাড়ানোর আকাঙ্ক্ষা বাদ রেখে আরেকটি তারা বাড়াতে চান।

পল পগবা ফিফার কাছে বলেছেন, ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতেন বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল করবেন। সেই স্বপ্নে একটি সংশোধনী এনেছেন, বিশ্বকাপ জিতবেন।

ফ্রান্স বিশ্বকাপ জিততে মরিয়া, খেলোয়াড়েরা সবাই সমস্বরে বলছেন এটি তাঁদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ। ক্রোয়েশিয়ার লুকা মদরিচ সংবাদ সম্মেলনে বলে গেলেন, এটি তাঁদের ছোট্ট দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ম্যাচ। সবার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ।

এই ম্যাচে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে অবশ্য মাঝমাঠের লড়াই। যেখানে লুকা মদরিচ অদ্ভুতভাবে আলোর মশাল হাতে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছেন ক্রোয়েশিয়াকে। সবাই বিমোহিত তাঁর নিঃশব্দ, নীরব অথচ বাঙ্ময় ফুটবলে। শুধু যে মাঠে সৃষ্টিশীল কাজ করছেন, তা-ই নয়। প্রয়োজনে গোল করছেন। তাঁর পাশে ইভান রাকিতিচও স্বকীয়তায় উজ্জ্বল। মাঝমাঠের এই জুটির নাম হয়ে গেছে ‘রা’-‘ম’। ‘রা’ যেমন-তেমন ‘ম’-টাই আসল। ফ্রান্স কীভাবে আটকাবে মদরিচকে? দেশম শুধু মদরিচকে নিয়েই ভাবছেন না, ‘ক্রোয়েশিয়া দলটি শুধুই মদরিচনির্ভর নয়। ওদের সবাই দুর্দান্ত। আমাদের সামগ্রিকভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে। ফাইনালে সেটি আপনাকে জানতেই হবে। আর্জেন্টিনা-বেলজিয়াম ম্যাচ আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। তবে ক্রোয়েশিয়ার জন্য আমরা নতুন করে ভেবেছি, জানি ওরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ম্যাচ ছাড়বে না।’

লরিস বরাবরই দলীয় চেতনার ঝান্ডা ওড়ান। কালও বলে গেলেন মাঠের প্রতিটি নড়াচড়ার মধ্যেই তাঁরা ধরে রাখতে চাইবেন দলীয় চেতনা। লড়াইটা করবেন এককাট্টা হয়ে। এত কাছে এসে সোনালি ট্রফিতে হাত ছোঁয়াতে না পারার ব্যর্থতায় তাঁরা পুড়তে চান না।

ক্রোয়েশিয়ার অসুবিধা হলো, টানা তিনটি নকআউট ম্যাচ অতিরিক্ত সময়ে খেলে ক্লান্তি। এই ক্লান্তির ব্যাপারটি যতই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টনিকের কাজ করুক, সত্যটা এই, ফ্রান্সের চেয়ে ৯০ মিনিট মানে একটি ম্যাচ তারা বেশি খেলেছে। আবার বিশ্রামও পেয়েছে একটি দিন কম। গত দুই দিন ক্রোয়েশিয়ার চার-পাঁচজন খেলোয়াড় অনুশীলন করেনি। ক্লান্তি কি তাহলে ক্ষমা করল না শেষ পর্যন্ত? জ্লাতকো দালিচ অস্বীকার করেননি, তবে যেমনটি বললেন, এটি তাঁদের কাছে প্রেরণাও। প্রয়োজনে বেঞ্চের খেলোয়াড় দিয়েও একাদশ গড়বেন। সেই একাদশও মাঠে শেষ রক্তকণা ঢেলে লড়াই করতে প্রস্তুত। ৪২ লাখ মানুষের স্বপ্ন সারা পৃথিবীকে উন্মাতাল করে দিয়েছে।

ক্রোয়েশিয়ার প্রতিজ্ঞার সঙ্গে ধৈর্যশীল অপেক্ষাও একটি বিষয়। প্রতিজ্ঞার সঙ্গে তারা মিশিয়ে দিচ্ছে ধৈর্য নামের মধুরতম অনুভূতি। ফ্রান্সের তারুণ্য সেই ধৈর্যের পরীক্ষায় না হেরে যায়! কিলিয়ান এমবাপ্পে বিশ্বকাপ ইতিহাসের তৃতীয় কনিষ্ঠতম খেলোয়াড়, যিনি গড়ে দিতে পারেন শিরোপা-ভাগ্য। আসল সময়ে ১৯ বছরের তরুণ প্রগল্ভ অহংকারের চোরাবালিতে হারিয়ে যাবেন না তো? দিদিয়ের দেশম বলে গেলেন, ‘কিলিয়ানকে এমনি যেমনই দেখাক, আমি তো জানি নিজেকে সে কতটা পরিণত করে তুলেছে।’

সুতরাং আজ লুঝনিকির সন্ধ্যায় বলা যাচ্ছে না কে পরবে বিজয়মুকুট। ফ্রান্সের তারুণ্য না ক্রোয়েশিয়ার প্রতিজ্ঞা? যে-ই জিতুক অনেক আলো, অনেক রং, অনেক সুর আর মহাসমুদ্র সমান গর্জনের মধ্যে মুকুটটা উঠবে মাথায়। আগের দিন উইল স্মিথ, ইরা এস্ত্রাফি ও নিকি জ্যাম মহড়া করে গেছেন সমাপনী অনুষ্ঠানের গানের। যে গানের শিরোনাম, ‘লিভ ইট আপ’-জেগে ওঠো।

আজ একটি দল প্রবলভাবে জেগে উঠবে লুঝনিকিতে। আরেকটি ব্যর্থতার, হতাশার, খুব কাছে এসেও না পাওয়ার বেদনার ভার বইবে অন্তত চার বছর।